বিদ্যুতের বকেয়া বিল আদায়ে বিশেষ দল মাঠে থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর এক শ্রেণীর অসাধু কমকর্তা ও বাৎসরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে গ্রাহকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুৎ সংযোগ চালু রাখা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বকেয়া পড়ছে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কাকরাইল ডিভিশনে বেশ কিছু গ্রাহকের ২০২৫ সালের মার্চ মাসের বিদ্যুৎ বিলের কপি বাংলা স্কুপের হাতে এসেছে। আর এই নথি ঘাটতে গিয়ে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। কাকরাইল ডিভিশনের প্রকৌশলীরা জানান, সপ্তাহের তিন-চারদিনই তারা বকেয়া আদায়ে অভিযান পরিচালনা করেন। সংশ্লিষ্ট বিতরণী কোম্পানির সঞ্চালন লাইনের দায়িত্বে থাকা কাকরাইল ডিভিশনের প্রকৌশলীরা ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বাৎসরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি দলকে দিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। আর এই অভিযানে বকেয়া বিল আদায় করতে গিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই তারা অফিসে চলে আসে। এতে প্রতিমাসেই বাড়ছে বকেয়ার পরিমাণ।
অভিযোগ রয়েছে, মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কো-অর্ডিনেটর মমিনুল হক ও সুপারভাইজার পিয়াস চৌধুরী এই অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত । আর তাঁদের সহায়তা করছেন কাকরাইল ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার গোলাম কিবরিয়া ও মো. রাকিবুল হাসান।
বাংলা স্কুপের হাতে আসা কিছু গ্রাহকের ২০২৫ সালের মার্চ মাসের বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া টাকা তুলে ধরা হলো। গ্রাহক নং- ১৬৩০৮২৬৭, বিল বকেয়া- ২৬,৬৪,০২৪ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬৩১০৩৭৭, বিল বকেয়া- ২৪,০৫,২৭৫ টাকা। গ্রাহক নং- ১৯২০৫৮০৭, বিল বকেয়া- ৭,৪৭,০৫৯ টাকা।গ্রাহক নং- ১৬১০২৫৪৭, বিল বকেয়া- ৪,৭৯,২৫৯ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬৩২৪৮৯৪, বিল বকেয়া- ৪,২৯,৮০৭ টাকা। গ্রাহক নং- ১৯২৬৯০১৯, বিল বকেয়া- ৩,০৩,৪৩৯ টাকা। গ্রাহক নং- ১৯২২৫০০২, বিল বকেয়া- ২,৯১,৫৮৫ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬২৯৭৩২৩, বিল বকেয়া- ২,৮৪,৯০৯টাকা। গ্রাহক নং- ১৬০৬৯৯৫০, বিল বকেয়া- ২,৪৫,১১৯ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬২৯৬২০২, বিল বকেয়া- ২,২৩,১৭৬ টাকা। গ্রাহক নং- ১৯২৬৮৩৬৪, বিল বকেয়া- ১,৮৪,৩৪৩ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬০৬৬১০৪, বিল বকেয়া- ১,৮২,৬৬৬ টাকা। গ্রাহক নং- ১৯০০১৫৮৭, বিল বকেয়া- ১,৩৩,৭৫৭ টাকা। গ্রাহক নং- ১৬০৬৬০৯১, বিল বকেয়া- ৫৮,০২৮ টাকা।
তথ্যমতে, কাকরাইল ডিভিশনের শুধু দুটি সঞ্চালন লাইনেই বকেয়া রয়েছে প্রায় কোটি টাকা। সূত্র বলছে, কাকরাইল ডিভিশনের মতো ডিপিডিসির অন্য ডিভিশনগুলোতেও বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া রয়েছে।
বকেয়ার কারণে কোনো গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও পুনরায় সংযোগ দিতে গেলে সংশ্লিষ্ট ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও সঞ্চালন লাইনের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীর অনুমতি নিয়েই তা করতে হয়। আর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর ওই গ্রাহক যদি টাকা পরিশোধও করে তখন তাকে সরকারের পুনঃসংযোগ ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে তা চালু করতে হয়। কিন্তু কাকরাইল ডিভিশনে অনেক সময় সরকারি ফি ব্যাংকে জমা ছাড়াই পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জানা যায়, এ ধরনের অভিযানে মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কো-অর্ডিনেটর মমিনুল হক ও সুপারভাইজার পিয়াস চৌধুরী গিয়ে থাকেন।
এর আগেও কাকরাইল ডিভিশনের বাৎসরিক ঠিকাদার মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম নিয়ে বাংলা স্কুপ একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরও ওই ডিভিশনে তাঁদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেমে নেই। পড়ুন :
গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎচুরি!
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কো-অর্ডিনেটর মমিনুল হক বলেন, যেহেতু ফিডার (সঞ্চালন লাইন) ইনচার্জ থাকেন না, তাই সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলের সঙ্গে আমার যেতে হয়। আমি যে সিদ্ধান্তই নিই, ফিডার ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলেই নিই। এ বিষয়ে ফিডার ইনচার্জই ভালো বলতে পারবেন। অভিযানে গিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেন।
মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুপারভাইজার পিয়াস চৌধুরী বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। মমিনুল হক স্যারের নির্দেশেই বকেয়া গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন অথবা চলমান রাখি। তিনিই ভালো বলতে পারবেন, গ্রাহকের সঙ্গে কী কথা হয়!
বাংলা স্কুপের হাতে আসা নথিতে সবচেয়ে বেশি বিল বকেয়া দেখা যায় ২৬,৬৪,০২৪ টাকা। এ বিষয়ে কাকরাইল ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. রাকিবুল হাসান বলেন, এই ফিডারের দায়িত্ব আমার নয়। যতটুকু জানি, ওই গ্রাহক বাণিজ্যিক গ্রাহক। টাকা আদায় হয়নি, আমরা মামলা করেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ভিন্নমত পোষণ করে তিনি বলেন, সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলে কোনো প্রকৌশলী থাকার কথা নয়। এতো টাকা কেন বকেয়া আছে, এ প্রশ্নের জবাব আমাদের নির্বাহী প্রকৌশলী দিতে পারবেন।
এদিকে, কাকরাইল ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও তেজগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুম মুঠোফোনে বাংলাস্কুপকে বলেন, এখানে আমি নতুন এসেছি। বকেয়া আদায়ে আমি বেশকিছু ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করেছি। আশা করি, জুনের আগেই সব বকেয়া আদায় করতে পারব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাৎসরিক ঠিকাদারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়েও আমি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমার ডিভিশনটি একটি ভিআইপি ডিভিশন। এখানে জনবলের সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল পেলে আরো ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করা যাবে।
বকেয়া গ্রাহকদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বিদ্যুৎ অফিসের প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের 'ম্যানেজ' করেই সংযোগ চালু রেখেছেন। তারপরও কখনো সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দল আসলে তাদেরকেও ম্যানেজ করা হয়। বকেয়া গ্রাহকরা বলছেন, সাময়িক সমস্যার কারণে বিল বাকি পড়েছে, ভবিষ্যতে তারা তা পরিশোধ করবেন। তারা আরো জানান, এই বকেয়া বিল তো একদিনের নয়। মাসের পর মাস বকেয়া ও সঙ্গে যোগ হয়েছে সুদের টাকা। তখন ডিভিশনের প্রকৌশলীরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি কেন?
কাকরাইল ডিভিশনে সরেজমিনে দেখা যায়, টাকা দিলেই মেলে যে কোনো সেবা। কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারী পর্যন্ত গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ, বিলের কিস্তিসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। ওই ডিভিশনের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী জানান, দীর্ঘদিন একই দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতির আখড়া গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি অনিয়মের অভিযোগে কাকরাইল ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলীকে বদলি করা হলেও রয়ে গেছে তার অধীনস্তরা।
বকেয়া আদায় প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বাংলা স্কুপকে বলেন, সরকারি দপ্তরগুলোতে বকেয়া টাকা ও গ্রাহক পর্যায়ে বকেয়া বিল আদায়ের জন্য বিতরণী কোম্পানিগুলোকে তাগাদাপত্র দিয়েছি। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সভায় জুনের আগেই বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূর আহমদ বাংলা স্কুপকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বকেয়া আদায়ে মাঠপর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। ইতিমধ্যেই ডিপিডিসির তিনটি ডিভিশন পরিদর্শন করেছি। পাশাপাশি, ডিপিডিসির আওতাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জোরালো পদক্ষেপ নিতে বলেছি। আশা করি, এই অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই শতভাগ বকেয়া আদায় সম্ভব হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাকরাইল ডিভিশনের অনিয়মের অভিযোগ আমি খতিয়ে দেখব।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এসকে